স্মৃতিবেদনা
>>>>>>>>>>> ড. ইউসুফ ইকবাল (১৯৮৭ ব্যাচ)
মিরসরাই পাইলট হাই স্কুলের শিক্ষকদের খুব মনে পড়ে। মাধ্যমিকের ৫ বছরের শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্য পেয়েছিলাম আহসানুল্লাহ স্যারকে। তখন তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ইংরেজি পড়াতেন। পিতৃব্যদের কাছে শুনেছি তিনি ছিলেন কিংবদন্তিতূল্য শিক্ষক। মজিবুল হক স্যার ছিলেন ধার্মিক। একারণেই হয়ত ধর্ম পড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন। অথচ মন উজাড় করে পড়াতেন বাংলা। সাহিত্য আর ব্যাকরণে তার পাণ্ডিত্য ছিল ঈর্ষণীয়। মনোবিলাস স্যারের চলন বলন ছিলো ধীর গতির। অথচ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পৌছে যেতেন বক্তব্যের কেন্দ্রে। তিনি গণিত পড়াতেন, বোঝাতেন, লিখাতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে গণিতের সমাধান করতেন। কোনদিন দেখিনি কাটাকুটি করতে। ছাত্রদের প্রতি বাৎসল্য স্নেহ ছিল তরণিস্যারের। পেটের চামড়া টিপে শাস্তি দিতেন অবাধ্য ছাত্রকে। সে শাস্তি যতটা না কষ্টের ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল আনন্দের। পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠত। মেশকাতের মতো ছাত্র আর পেলেন না বলে আক্ষেপ ছিলো তাঁর। শ্যামলস্যারের পড়ানোর ধরনটাই ছিলো স্বতন্ত্র। ক্লাসে ঢুকেই একটা হাসির গল্প বলতেন। এর পর পাঠে ঢুকতেন। আনন্দচিত্তে উপভোগ করেছি তার গণিত আর বিজ্ঞানের ক্লাস। ক্লাস শেষ হতো পুনরায় হাসির গল্পে। সে গল্পের রেশ ছড়িয়ে যেত পরবর্তি ক্লাসে। এভাবে তিনি পরবর্তি ক্লাসকেও পাঠদানের জন্য উপযোগী করে যেতেন। বশরস্যার ছিলেন মহাপুরুষ। বইয়ের পাঠের চেয়ে বেশি দিয়েছেন জীবনের পাঠ। এমন সজ্জন মানুষ কালেভদ্রে দেখা যায়। ছাত্ররা তার কাছে ছিল আপন সন্তানতূল্য। পড়া না শিখলে দাঁতমুখ খিচে, চোখ বড় করে মারাত্মক ভঙ্গিতে বলতেন- 'একেবারে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবো'। তারপর সজোরে হাত তুলে আস্তে করে একটা বাড়ি দিতেন পিঠে। সে আঘাতে হয়ত মশাও মরবে না। তবুও তিনি ছাত্রের পিঠে অন্তত ৫/৬ বার হাত বুলিয়ে দিতেন পরম মমতায় । নারায়ণস্যার ছিলেন একজন বিষ্ময়কর শিক্ষক। পাঠদান করতেন নাটকীয় ভঙ্গিতে- অভিনয় সহযোগে। আঙ্গিক এবং বাচিক নানা ক্যারিকেচারের মাধ্যমে নীরস ও জটিল বিষয়কে বুঝিয়ে দিতেন আনন্দময় আবহে। তার ক্লাস ছিলো জ্ঞান ও বিনোদনের অফুরন্ত উৎস। সিরাজুদ্দৌলাস্যার পড়াতেন নীরস ভূগোল। হয়তো কেউ রাজি হননি বলেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হয়েছেন এ বিষয়ে পাঠদানে। ভূগোলের দ্রাঘিমাংশ, অক্ষাংশ, নিরক্ষরেখা, কর্কটক্রান্তি রেখা প্রভৃতি তিনি পড়াতেন; সাধ্যমত চেষ্টাও করতেন বোঝাতে। কিন্তু আমরা খুব বুঝেছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো বিষয়গুলো তাঁর কাছেও খটমটে মনে হতো। কিন্তু, তার আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টায় কমতি ছিলো না। কোনোদিন দেরি করে ক্লাসে ঢুকেননি। দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। সিরাজুল মোস্তফা স্যার ছিলেন সুদর্শন সবুজ শিক্ষক। ফ্যাশন সচেতন। প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণী ক্ষমতা ছিলো। আমরা মুগ্ধ হতাম তাঁর সংস্পর্শে। মাধ্যমিকের শেষ পর্যায়ে পেয়েছিলাম জানে আলম স্যারকে। ইংরেজির শিক্ষক। ভয় পেতাম। কিন্তু তাঁর ক্লাসের প্রতি আমাদের আলাদা মনোযোগ ছিল। আরো দুজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম একজন চিত্তরঞ্জনস্যার অন্যজন রৌশনস্যার। এদুজন তখন তরুণ শিক্ষক।
ত্রিশ বছর পর ধুলি মাখা স্মৃতি উকি দেয় মনের আকাশে। আমার শিক্ষকরা আজ কে কোথায় আছেন- কেমন আছেন জানি না। এরা সবাই ছিলেন অনুসরণীয় অনুকরনীয় আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষকতাকে তাঁরা গ্রহন করেছিলেন জীবনের ব্রত হিসাবে। শিক্ষকতা একটি মহান ব্রত। আজ যখন দেখি অজস্র অসৎ মানুষ মহান ব্রতকে প্রতিনিয়ত দুষিত করছে, তখন উপর্যুক্ত শিক্ষকদের সততা ও আদর্শের কথা ভেবে বিষ্মিত হই। এদের জীবন ছিল লোভ ও মোহমুক্ত। প্রলোভনের কাছে কখনো তাঁরা নিজেকে সমর্পণ করেন নি। এসব মহৎ ব্যক্তিরা সারাজীবন ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। এদের নিয়ে প্রকাশিত হয়নি কোন ফিচার বা প্রতিবেদন। নির্মিত হয়নি কোন অডিও ভিজ্যুয়াল প্রামান্যচিত্র।
তাতে কী ! এরা তো হারিয়ে যান নি। আমার শিক্ষকরা আজও আছেন আমার হৃদয়মন্দিরে- দেবতার আসনে।
-------------------------------------------------------------
আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করুনঃ www.alumnimphs.com
--------------------------
এই ব্লগ এ লিখতে আপনার লিখা মেইল করুনঃ alumnimphsblog@gmail.com
--------------------------
এই ব্লগ এ লিখতে আপনার লিখা মেইল করুনঃ alumnimphsblog@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন