প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ; মীরসরাই সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ঃ- কিছু কথা
-----------------------------এম, গিয়াস উদ্দিন (ব্যাচঃ ১৯৭৮)
চিন্তা মানুষের সহজাত প্রবণতা। যুগে যুগে এ চিন্তা সৃষ্টিশীলতার বাহন। মানুষের এ চিন্তার ফসল আজকের এ বিশ্বসভ্যতা। পৃথিবীর অন্য কোন প্রানী তা পারেনি। বিশ্বব্যাপী এ সভ্যতা কিন্তু সুদূর আকাশ থেকে কিংবা পাতালের অতল গভীর হতে হঠাৎ বেরিয়ে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে মানুষের শ্রম, মেধা, গভীর অধ্যাবসায়, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অর্জিত জ্ঞানের সুনিপুন বাস্তব প্রয়োগ। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, "আজকের শিশু আগামীদিনে জাতির ভবিষ্যৎ।" কিন্তু বর্তমানে তারা কী? কোথায় ও কেমন আছে? জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে আত্মপ্রকাশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ তাঁদের অনুকুলে কতটুকু আছে, তা নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা কারো মাঝে তেমন নেই। যতটুকু পরিবেশ বিরাজমান তা প্রায় গতানুগতিক। একে সভ্যতা বিকাশের যুগোপযোগী বলা মানে, নিছক বাতুলতা বৈকী। এবং এ প্রশ্নের যথার্থ কোন জবাব মেলেনা। তাহলে শুধু কী ফি বছর অতিবাহিত করে একটি মানব সন্তান কেবল শারীরিকভাবে বেড়ে উঠলেই সে কী জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী বলে বিবেচিত হবে? যেকোন মানুষের চিন্তা-চেতনা বিকশিত করার যথার্থ মাধ্যম তার শিক্ষা। তাহলে এ শিক্ষার লক্ষ ও উদ্দেশ্য বলতে কী বোঝায়? স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করুন, তারা কী বলতে চায়? দেখবেন, চোখের পলকে তারা উত্তর দেবে যে, ছাত্রজীবন শেষে একটা ভাল চাকুরী। দেখুন, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা আর কাকে বলে? শুধু নিজের সুখবিলাসের পেছনে ধাবমানের এ মানসিকতা সম্পন্ন ছাত্র, তরুন, যুব সমাজ কীভাবে জাতির আশা-ভরসার প্রতীক হবে? সৃষ্টির সুখের উল্লাসে উদ্বেলিত "সকলে আমরা সকলের তরে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে" -এ সুমহান ধ্যান-ধারনাসহ মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা কী তারা অর্জন করতে পারছে? আবার দেশ, জাতি ও সমাজ প্রেমের যেটুকু শিক্ষা তারা পেয়ে থাকে তা বাস্তবে পরিচর্চা করার কোন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুকুল পরিবেশ কী চলমান সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান?
আসল কথা হলো, আমাদের শিক্ষার ভাবাদর্শগত ভিত্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার অবকাশ রয়েছে। ছাত্রসমাজ ও জাতির প্রত্যাশা কী? পড়ালেখার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বড় বড় শিক্ষাসনদ অর্জন? নাকি মনুষ্যত্ববোধের আলোকে দেশ, সমাজ এবং জাতি প্রেমের নির্মল চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে একজন খাঁটি, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠা? সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে যুগের দাবী ও বিকশিত জীবনের প্রয়োজনে অতীতের পুরোনো নিয়মনীতি, রুচি-সংস্কৃতি এবং ধ্যান-ধারনার আমুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা আজকের এ পরিসরে উপনীত হয়েছি। আজকের এ সংগ্রাম-মুখর জীবনে হতাশা, অস্থিরতা সহ নানা প্রকার মানসিক ব্যাধিতে জর্জরিত হয়ে নিজেকে পথহীন অজানা পথে হারিয়ে ফেলা মানে জীবনের সকরুন মৃত্যুঘন্টা বাজানোর শামিল। আশাহীন ও স্বপ্নহীন যে কোন মানুষ অতি সহজে হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকার চোরাগলির ঠিকানাহীন অচেনা পথে। বর্তমানে সকল স্তরের ছাত্র-ছাত্রী, তরুন এবং যুবসমাজ বিছিন্ন কোন জীব নয়। এ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর জন্ম নেয়া যে কোন অন্যায়, অনাচার, শোষণ- বঞ্চনা সর্বপ্রকার রুচিহীন অপসংস্কৃতি সহ উন্নত ও সাবলীল জীবনবিরোধী প্রতিটি অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলন করতেই হবে। মোটাদাগে বলতে গেলে, জীবনের সর্বত্র আমাদের প্রত্যেকের সর্বমুখী আশা- আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রয়োগের পরিচর্যা দেশ, জাতি এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত স্বপ্ন বাস্তবের পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ও বিদ্বেষী চিন্তা চেতনা পরিহার করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
যাক, এবার আসল কথায় ফিরে আসি। মীরসরাই সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের আত্মপ্রকাশ একটি দুরন্ত প্রয়াস। ১৯৬২ সাল থেকে আজকের এ ২০১৮ সালের আগের বছর পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৬ বছরের ইতিহাস বিদীর্ণ করে এ পরিষদের উদ্যোক্তা প্রাক্তনবৃন্দ অবশ্যই সমাজ সচেতন ও দুঃসাহসিক। সামাজিক দায়বদ্ধতার গঠনমূলক চেতনার সাবলীল দৃষ্টান্ত যারা সৃষ্টি করলেন তাঁদের প্রত্যেককে আমার শ্রদ্ধাবিজড়িত স্যালুট। এ পরিষদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের প্রতি রইলো আন্তরিক অভিনন্দন। যে কথাটা না বললেই নয় তা হচ্ছে বর্তমানে কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপরের মঙ্গলকামনায় দৃশ্যমানকর্মে তেমন এগিয়ে আসেনা। চলমান এ লোভাতুর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক প্রচারনায় তিলকে করছে তাল। ভিত্তিহীন বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণের সব রকমারি পোস্টার আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিথ্যা আত্মপ্রচারনায় মেতে উঠেছে ও উঠছে। আজকের এ বানিজ্যিক জগতে যারা স্বেচ্ছায় সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিক সেবায় উদ্বেলিত, কতজন তাঁদের সম্মান ও বিশ্বাস করে? বরং অবজ্ঞা প্রদর্শনের পাল্লাটাই ভারী।
আমাদের এ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় এমন কিছু লোক ছিলেন এবং বর্তমানেও কিছু আছেন যারা প্রকৃতিগতভাবে আত্মপ্রচারবিমুখ। তাঁদের সুন্দর, সাবলীল ও গঠনমূলক সামাজিক কর্ম এবং গুনাবলী থেকে আমাদের ভাবাদর্শ মানসিকভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু আমরা তাঁদের কর্মপদ্ধতি অনুসরনে ভীষণভাবে উদাসিন। যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ উদাসিনতা যতবেশি বিরাজমান ওই সমাজ ততবেশি অধঃপতিত। যার উদাহরন আমাদের এ সমাজ ও আমরা। তবে একটি বিষয়ে আমি আনন্দিত ও গর্বিত না হয়ে পারি না যে, মীরসরাই সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ এ স্বার্থপরতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পেরেছে বলে। ইতোমধ্যে এ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ বিদ্যালয়ের পরিছন্ন শিক্ষা বিকাশ সহ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া এবং জাতীয় দিবসগুলো যথাযথ মর্যাদায় সাধ্যানুসারে পালনের ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া, সামাজিক গণসেবামূলক কার্যক্রম পরিচলনা করে সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা লাভ করেছে। আমাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে দিনগুলোতে সমাজ সচেতন ও সৃজনশীল গঠনমূলক ব্যাপক কর্মকান্ডে আলোচিত সফলতা লাভ করা এ সংগঠনের জন্যে একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ পরিষদের সম্মানিত সভাপতি যিনি বড়দের কাছে পরম স্নেহের ও ছোটদের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও জ্ঞানীগুনী প্রিয় ব্যাক্তিত্ব, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। তাঁর সাথে অনাবিল তারুন্যের প্রতীক এবং দুর্বার কর্মশীলতায় উদ্বেলিত সাধারণ সম্পাদক প্রবাল ভৌমিক। বর্তমান কার্যকরী কমিটির প্রত্যেকেই এবং সাধারণ সদস্যমন্ডলীর গভীর মনোবাসনা এ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের অবারিত উন্নতি ও সমৃদ্ধি। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিতে সকলেই সুদৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেষান্তে বিপ্লবী কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই-
" চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ
তারপর হব ইতিহাস।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন