মুখস্থ বিদ্যা
মাষ্টার এম, গিয়াস উদ্দিন
ব্যাচঃ ১৯৭৮
ব্যাচঃ ১৯৭৮
পৃথিবীতে আলোচিত কোন অর্জনই সহজলভ্য নয়, দুর্লভ। কারো হিমালয় বিজয়ে আমরা সানন্দে লাফিয়ে উঠি। কিন্তু আমাদের পুবদিকের এ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নামমাত্র উঁচুনিচু স্থানে উঠে নিচে তাকানোর সাহস তেমন কারো নেই। মনের সাহসই হলো মানব জীবনের সফলতার অন্যতম বিশেষ উপাদান। গ্রাম্য ছোট্ট পুকুরে সাঁতরানোর অভ্যেস যাদের নেই, ছোটবড় নদী সাঁতরিয়ে ওপারে যাবার ইচ্ছে তাঁদের ভেতর জাগ্রত হবার কথা ভাবাতো নিছক পাগলামি। সে যুগে সমগ্র ভারতবর্ষের শিক্ষা ও শিক্ষানীতির সকরুন অবস্থা দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “মদ খেয়ে মাতলামি করে দোষ দেয় তালগাছের।” মানে, সে যুগে তালের রস দিয়ে এক প্রকারের মদ তৈরী হতো। আসলে, আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাবকাশের নানান উপদানগুলোর যথাযথ বাস্তব প্রয়োগের নিয়মনীতির উপর নির্ভর করে সমাজ ও মানুষের প্রকৃত বিকাশ।
অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং অভিভাবকমন্ডলীর মধ্যে কোন কোন চরম গাফিলতির কারণে আমাদের শিক্ষানীতি বারংবার হোঁচট খাচ্ছে। সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের আশাহত দুর্বলতা ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যত দিনগুলোতে কী হবে তা আমাদের অজানা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে সরকারের নির্ধারীত কতগুলো পাঠ্য বইয়ের সীমিত সিলেবাস কবিগুরু রবীঠাকুর কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি। ফলে এ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পদ্ধতির প্রতি তাঁর ছিলো চরম অনীহা। মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী লোককে বিশ্বকবি শিক্ষিত ব্যক্তি বলে স্বীকৃতি দেননি। অর্জিত জ্ঞানের সৃজনশীল প্রয়োগের প্রতি ছিলো তাঁর শতভাগ অনুরাগ। মুখস্থ বিদ্যার চরম কুফল তিনি ব্যাঙ্গাত্মক হাস্যরসের মাধ্যমে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বর্নণা করে গেছেন। আমার বেশ মনে পড়ে হাইস্কুল জীবনের সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের একজন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক (আমি খুবই দুঃখিত যে এ মুহূর্তে স্যারের নামটা স্মরণ করতে পারছি না) কবিগুরুর ‘তোতাপাখী’ গল্পটা সংক্ষেপে ক্লাসে আমাদের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছিলেন। প্রত্যেক ছাত্রের হাসির কোন সীমা ছিলো না। রবীঠাকুরের সেই বিখ্যাত গল্পটার সারমর্ম হলো:- কোন এক বাদশার রাজদরবারে খাঁচার ভেতর একটি তোতাপাখি ছিলো। সে সারাক্ষণ খাঁচায় লাফালাফি ও চেঁচামেচি করতো। বাদশাহ একদিন তাঁর সভাসদের সদস্যদের ডাকলেন। উজির নাজির সহ সবাই হাজির হলো রাজদরবারে। বাদশাহ বললেন, আপনারা এ তোতাপাখিটাকে নিয়ে এমন শিক্ষা দেবেন যাতে সে এভাবে আর লাফালাফি করতে না পারে। উজির নাজির সবাই মিলে সেই পাখিটাকে নিয়ে গেলো। তারপর বাদশাহর মহাজ্ঞানী ব্যক্তিবর্গমন্ডলী প্রত্যেকে পালাক্রমে তোতাপাখিকে শিক্ষা দিতে লাগলো। প্রতিদিন জ্ঞানবিজ্ঞানের বড় বড় বই খেতাবগুলোর পাতা ছিঁড়ে তার ছোট টুকরা পাখিটার ভেতর প্রবেশ করাতে লাগলো। কিছুদিন পর বাদশাহ আবার সভাসদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন তোতাপাখির শিক্ষা কেমন হলো। উজির নাজির সাবই আনন্দে চিৎকার করে বললো হুজুর পাখিটা যা শিখেছে তা দেখলে আপনি অবাক হবেন। বাদশাহ বললেন ঠিক আছে, এখন পাখীটাকে আমার সামনে নিয়ে আসা হোক। যে কথা সে কাজ। তোতাপাখিকে বাদশাহর সামনে আনা হলো। বাদশাহ হাত দিয়ে নড়াচড়া করে দেখে বললেন, কী ব্যাপার? সেতো আগে ছিলো খুবই চঞ্চল, এখনতো দেখছি একেবারেই নিরব। বাদশাহ পাখিটার পেটের উপর হাত দিয়ে অনুভব করলেন যে, তোতাপাখিটার পেটের ভেতর কতগুলো কাগজ শুধু খচ্খচ্ করছে। এরপর তোতাপাখিটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কবলে লুটিয়ে পড়লো। এইতো মুখস্থ বিদ্যার সকরুন পরিনতি। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এ চরম দুর্গতি থেকে মুক্ত হবে কবে ও কখন??
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন