শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং শ্রেণিপাঠ

মাষ্টার এম, গিয়াস উদ্দিন (ব্যাচঃ ১৯৭৮)
সাহসী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে ঠিক কী বোঝায়? মায়ের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা বলতে আমরা কি বুঝি? তার একটি বিশেষ ধারণা আমরা এ আলোচনায় পেতে পারি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম শুনেনি শিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে খুবই কম আছে। বিগত প্রায় সুদীর্ঘ বছর আগের কথা হলেও বিষয়টি এখনও আমার স্মৃতিপটে বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে আমাদের বাংলা পড়াতেন অত্র এলাকার হাজারো ছাত্রছাত্রীর প্রিয় শিক্ষক বাবু সুভাষ চন্দ্র আচার্য্য। তিনি বিগত বেশ কিছু বছর আগে নিয়ম মাফিক অবসরে গেছেন। তিনি মীরসরাই হাই স্কুলের ১৯৬৭ ব্যাচের ছাত্র। 

যাক আসল কথায় ফিরে আসি। সেদিন নিয়মানুসারে স্যার ক্লাসে এলেন। ছাত্রছাত্রীদের বাড়ীর কাজ সহ খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো দেখলেন। তারপর বই হাতে নিয়ে বললেন আজকের পড়া হচ্ছে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’। এ প্রথমবারের মত আমরা বাংলা সাহিত্যের বিশাল জ্ঞানী গুনী ও মানবতাবাদী একজন ব্যাক্তিত্বের নাম শুনলাম। প্রথমে স্যার তেমন কিছু বলেননি। বই দেখে Reading পড়া শুরু করলেন। তারপর আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় স্যার বই বন্ধ করলেন। সেই আলোচিত বিষয়ে মায়ের আদেশ ও ঈশ্বরচন্দ্রের বিরল কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে স্যার যেভাবে সহজ সরল ভাষায় হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করলেন তা ছিল এককথায় অপূর্ব। যথারীতি স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠল। স্যার অন্য ক্লাসে চলে গেলেন। বাড়ি গিয়ে আমরা অনুশীলনীর সেই পড়া পুনররায় অধ্যয়ন করার প্রয়োজন তেমন মনে করিনি। যদিও ২/১ বার পড়েছিলাম বটে। স্যার যা আলোচনা করেছেন আমাদের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর ওই বিষয়ে ক্লাসে জানা ও বোঝার ব্যাপারটা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এভাবে শিক্ষা জীবনের প্রত্যেক স্তরে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী কোন বিষয় না বুঝে শুনে মুখস্থ করার প্রতি সর্বদা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করতেন। মুখস্থ বিদ্যার কুফল নিয়ে বারংবার আদেশ, উপদেশ এবং নির্দেশ দিতেন।

সেদিনের আলোচ্য বিষয়টি ছিল ........... ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলিকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক। বড় ভাইয়ের বিয়েতে বাড়ী আসার জন্যে তাঁর মা চিঠি পাঠিয়েছেন। পত্র পাঠান্তে ঈশ্বরচন্দ্র আরো সবকিছু অবগত হলেন। মা বলেছেন, “এ বিয়েতে তোকে বাড়ী আসতেই হবে।” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন একজন ব্রিটিশ। ইশ্বরচন্দ্র ছুটির দরখাস্ত লিখে অধ্যক্ষের অফিসে গেলেন। দরখাস্ত পড়ে সেই ইংরেজ অধ্যক্ষ বললেন ‘এ মুহূর্তে ছুটি দেয়া যাবেনা।’ চোখের পলকে ঈশ্বরচন্দ্র চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখুন, চাকুরিতে ইস্তফা দেয়া যায়, কিন্তু মায়ের আদেশ লঙ্ঘন করা যায় না।” বিদ্যাসাগরের এ দৃঢ়মানসিকতা দেখে ইংরেজ অধ্যক্ষ সাহেব তাঁকে ছুটি দিতে বাধ্য হলেন। এরপর বাড়ি ফেরার পালা। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢাকা, অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপরে একখানা ছাতা নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ীর পথে যাথা করলেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে কাঁদাজলে ভিজে একাকার হয়ে গেলেন। অবশেষে গভীর রাতে বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছালেন। এবার সামনে একটা নদী। এ নদীর ওপারে ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ী। বিরামহীন বৃষ্টির পানিতে নদীতে প্রবল ভয়ঙ্কর স্রোত। কিন্তু ওই যে মায়ের আদেশ যা তাঁকে যে কোন প্রকারে পালন করতে হবে। ক্ষণকাল দেরি না করে তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে অন্ধকার রাতে সাঁতরিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে উঠলেন। এবং অবশেষে বাড়ী গেলেন। এখানে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জন্যে অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। এ বাস্তব শিক্ষা তাদের প্রত্যেকের জীবন চলার পথে গুরুত্বের কোন সীমা পরিসীমা নেই। কোন কঠিন ও কঠোর কাজ করতে হলে একজন মানুষের যে মানসিক দৃঢ়তা ও সাহস প্রয়োজন তা এ আলোচনায় সহজেই বোঝা যায়। অপরদিকে, মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালাবাসার যে দৃষ্টান্ত আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে পেলাম তা অনুসরণ ও অনুকরণের পরিচর্যা আমাদের প্রত্যেককে বাস্তবে চালিয়ে যেতে হবে। মোটকথা হলো, ক্লাসের পড়া সেই ক্লাসেই প্রায় শেষ করা যায়, যদি তেমন শিক্ষক ও মনযোগী ছাত্র হয়। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

" বিজয় ও অভ্র " ----যাদের কল্যাণে আমরা বাংলায় কথা বলি

মা

প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের পথচলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ