বন্ধন

জান্নাতুল কারিশমা (সিমী), ১০ম শ্রেণি
মীরসরাই সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়
বাবার সরকারী চাকরি হওয়ায় বাবাকে অনেকবার বদলি হতে হয়। আগে ছিলাম কুমিল্লায়, এখন ঢাকায়। আজকে নতুন বাসায় শিফট হচ্ছি। ঢাকায় আমি আগে অনেকবার এসেছি কিন্তু এবার পারমানেন্টলি এলাম। গাড়ি থেকে নামলাম। দেখি খুব বড় বিল্ডিং। গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা বল আমার হাতের কাছে এসে পড়ল। বলটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে এটিু সামনে এগুতেই দেখি একটি পাঁচ বা ছয় বছরের মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু সে আমার হাত খেকে বলটা নিয়ে দৌড়ে তার বাসায় ঢুকে পড়ল। এর মধ্যে মা আমাকে ডাকছে। মার ডাকে আমি বাসায় ঢুকে পড়লাম। এরপর মার সাথে ঘর ঠিক করার কাজে লাগালাম। 
এরপর নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি আর নতুন জায়গায় এডজাস্ট করতে করতে সে মেয়েটির কথা খেয়ালই নেই। এখাবে প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেল। একদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখি আম্মুর সাথে একজন প্রতিবেশি দেখা করতে এসেছেন। তাকে সালাম দিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখি সে বাচ্চাটা নির্দ্বিধায় আমাদের ড্রয়িং রুমে বসে মটু-পাতলু দেখছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল তার নাম ঋতু। এরপর সে আমার নাম জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, আমার নাম আকাশ। এরপর পাশের রুম থেকে ঋতুর আম্মু তাকে ডাক দিল। ঋতু ‘আসছি’ বলে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় তাকে একটা চকলেট দিলাম। সে চকলেট পেয়ে দৌড়ে তার আম্মুকে দেখালো। তার আম্মু তাকে বলল-
তুমি ভাইয়াকে ধন্যবাদ বলেছ?
না।
এখনি যাও। 
সে দৌড় দিল। এভাবে প্রতিদিন ঋতু আমাদের বাসায় আসত এবং আমি তাকে চকলেট দিতাম। হঠাৎ একদিন বাইরে যাওয়ার সময় দেখলাম ঋতু সিঁড়ির নিচে একা বসে কাঁদছে। আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম আর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-
কী হয়েছে, কাঁদছ কেন? 
সে বলল, আমি আজ খুব দুঃখী।
কেন?
আমার একজন বান্ধবী আছে, তার নাম রিভা।
ও এটা তোমার দুঃখের বিষয়!
সে বলল, না।
তাহলে?  
আজ রিভার জন্মদিন ছিল।
তুমি এজন্য দুঃখী?
আরে না, ভাইয়া।
তাহলে?
রিভার একটি ভাই আছেন। তিনি রিভাকে অনেক আদর করেন আর তিনি রিভাকে অনেক বড় একটি জন্মদিনের উপহার দিয়েছেন কিন্তু আমার তো কোন বড় ভাই নেই। আমাকে কে আদর করবে? কে আমাকে জন্মদিনে উপহার দিবে? 
আমি বললাম, এ কথা? আরে পাগলি, তুমি তো কিছুক্ষণ আগেই আমাকে ভাইয়া ডাকলে। আর এখন বলছ ভাই নেই! 
ঋতু খুশি হয়ে গেল। সেদিন বিকালে আমার কিছু বন্ধুরা বাড়িতে এলো। যথারীতি ঋতুও এলো। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, এ মেয়েটা কে? আমি বললাম, আমার ছোট বোন ঋতু। ঋতু খুব খুশি হয়ে গেল। আম্মু খাবার টেবিলে খাবার খেতে ডাকল সাবাইকে। আমরা সাবাই খেতে গেলাম। তখন হঠাৎ করে রিফাত বলল, পরশু তো তোর জন্মদিন, তাই না? আমি বললাম, হ্যাঁ। ঋতু বলল, ভাইয়া তোমার জন্মদিন! আমি তোমাকে উপহার দেব। আমি বললাম, দিও। সে ঠিকাছে বলে চলে গেল।
জন্মদিনের দিন ভার্সিটিতে বন্ধুবান্ধবরা সবাই মিলে আমার জন্মদিন উদযাপন করল। অনেক উপহারও পেলাম কিন্তু আমি অপেক্ষা করছিলাম বাসায় গিয়ে ঋতুর উপহারটা পেতে। বাসায় ফেরার সময় ওর জন্য দুটি চকলেট কিনলাম এবং ভাবছিলাম ঋতু আমার জন্য কী উপহার রেখেছে। 
বাসায় ফিরে দেখলাম সেখানে কেমন জানি নিস্তব্ধতা। দেখলাম ঋতুদের বাসার দরজা খোলা ও মেঝেতে রক্ত পড়ে আছে। মন কেমন জানি আঁতকে উঠল। কেমন যেন একটু  ভয় মনে কাজ করতে লাগল। হঠাৎ করে মায়ের ফোন এলো।
আকাশ, তুই কোথায়? জলদি সিটি হাসপাতালে আয়।
কেন?
ঋতু হাসপাতালে। তুই জলদি আয়।
আমার হাত পা  যেন অবশ হয়ে গেল। মনে হলো পিঠটা দেয়ালে ঠেকে গেছে। কাঁদতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছি না। খুব দৌড়েই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গেলাম। তখন আমার শরীর কাঁপছিল। ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ফুল স্পিডে চললেও আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল রাস্তা শেষ হচ্ছে না। সিটি হসপিটাল আমাদের বাসা থেকে কুড়ি মিনিটের দূরত্ব কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে রাস্তা শেষ হচ্ছে না। হসপিটালে পৌঁছালাম। সেখানে দেখি ঋতুর আম্মু কাঁদছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। মা বলল-
ঋতু তোন জন্মদিনের জন্য তাদের বাসায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিল। ওর মা রান্না করছিল। ঋতু ঘর সাজাচ্ছিল। সে ডাইনিং টেবিলের ওপরে উঠে ফ্যানের উপর বেলুন লাগাচ্ছিল। হঠাৎ তার পা পিছলে টেবিল থেকে মাটিতে পড়ে যায়। যার কারণে মাথায় প্রচুর আঘাত পায় এবং প্রচুর রক্তও ঝ ঝড়েছে। 
এ কথা শুনে যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। মনে মনে নিজেকে এর জন্য দায়ি করতে লাগলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা ঋতুর অপারেশন হলো। এরপর ডাক্তার এসে বলল ঋতুর অবস্থা ভালো না। আপনারা তার সাথে দেখা করে নিন। খালা আর মা ভিতরে ঢুকলো। আমি ঢুকতে গিয়েই পা সরিয়ে নিলাম। ঋতু তার মাকে কাঁদতে দেখে বলল-
আম্মু, তুমি কাঁদছ কেন? আমি ঠিক হয়ে যাব আর ভাইয়া কই?
আমি আমার চোখের পানি মুছে হাসি মুখে ওর সামনে গেলাম। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল-
ভাইয়া, আমার চকলেট কই?
আমি তাকে দুটি চকলেট দিলাম। ঋতু বলল-
ভাইয়া, আমি ঠিক হলে একসাথে বাসায় যাব আর তোমার জন্মদিন পালন করব। আমি তোমার জন্য একটি উপহার বানিয়েছি, সেটা তোমাকে দিব।
আমি বললাম, ঠিকাছে।
ঋতুর ইচ্ছা পূরণ হলো। আমরা দুজন একসাথেই বাসায় এলাম কিন্তু ঋতু ফিরল লাশ হয়ে। নিজ হাতে আমার আদরের বোনকে মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসলাম।
দু’দিন পর হঠাৎ খালা বাসায় আসলেন। আমাকে ডাকলেন। আমি এলাম। তিনি আমার হাতে গিফট পেপারে মোড়ানো একটি বাক্স দিলেন আর বললেন-
ঋতু তোমার জন্য এ উপহারটি রেখেছিল কিন্তু দিতে পারলনা।
আমি গিফটটি খুললাম। দেখলাম বক্সে একটি পুতুল, চারটি চকলেট, একটা মাথার রিবন আর কিছু কাগজের ফুল এবং একটি চিঠি। চিঠিতে আঁকা বাঁকা লেখা কিন্তু আমি ঋতুর লেখা বুঝতে পারতাম। ঐ চিঠিতে লেখা ছিল-
এসব জিনিসগুলো আমার খুব প্রিয় কিন্তু তুমি আমার ভাইয়া। তাই এগুলো তোমার।
উপহারগুলো পেয়ে মনে হচ্ছিল যেন ঋতু আমার পাশে রয়েছে।
আমি আজও ঋতুর জন্য চকলেট আনি কেন্তু সে চকলেট খাওয়ার মতো কেউ নেই। আমার ছোট্ট বোনটি আর নেই। সে হারিয়ে গেছে দূর আকাশে, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

" বিজয় ও অভ্র " ----যাদের কল্যাণে আমরা বাংলায় কথা বলি

মা

প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের পথচলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ