শুভ ও সফল হোক ডাকসু নির্বাচন

মাষ্টার গিয়াস উদ্দিন
ব্যাচঃ ১৯৭৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্রসংসদ তথা ডাকসু মানে এ বাংলা এবং বাঙালির রক্তাক্ত ও দুঃসাহসিক গর্বিত ইতিহাসের মহাভিত্তি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। সেদিনের ছাত্রনেতা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানধ্যান ও বিজ্ঞোচিত দূরদর্শিতার কাছে পাকিস্তান সরকারের বাঘা বাঘা মন্ত্রী ও জেনারেলেরা চরমভাবে পরাজয় বরণ করেছিলো। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, সমগ্র বাঙালি জাতির উন্নতির পেছনে তার ভাষা, কৃষ্টিসভ্যতা ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ব্যতীত ভিন্ন কোন পথ নেই। অনেক বাগ-বিতন্ডা আর ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন ১৯৫২ সালের কোঠায়। এ ভাষা আন্দোলন ছিলো মূলতঃ সংস্কৃতির লড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দাঁড়িয়ে গেলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আন্দোলনে। 

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে  সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ যে সংগ্রামের নবযাত্রা শুরু করলেন, পরবর্তীতে এ ডাকসু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তা আরো বেগবান হলো। ভাষাসহ সমগ্র বাঙালির সকল মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার তীব্র আপোষহীন সংগ্রামে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্রসংসদ তথা ডাকসু ছিল জাতির আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা যখন ভীরুতা ও আপোষকামিতায় মুখ লুকিয়ে “চাচা আপন বাঁচা” নীতি অনুসরণ করে চলেছেন, ছাত্রসমাজ সেদিন শাসকের বুলেটের সামনে পেতে দিয়েছেন সাহসী বুক। রাজপথ করেছেন লালে লাল, বরণ করেছেন শহিদী মৃত্যু। এপথ বেয়ে রচিত হলো- ৫২,৬২,৬৬ ও ৬৯ এর মহান ‍গনঅভ্যুর্ত্থান। অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে আলোচনা ও তাঁদের সিদ্ধান্তের তেমন কোন তোয়াক্কা ছাত্রসমাজ করেনি। এ দুঃসাহসিক আন্দোলন সংগ্রামের মূল নেতৃত্বে ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় সংসদ তথা এ ডাকসু। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, তরুন এবং যুব সমাজ তাঁদের আদেশ, নির্দেশ ও উপদেশ অনুসারে সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নের সর্বচেষ্টা চালিয়ে যেতো। 1970 সালে এসে এ ডাকসুর নেতৃবৃন্দ সেদিনের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদসহ বাংলা বাঙালির মুক্তির স্বপক্ষে এমন কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করলো যা ছিলো সেদিনের পাকিস্তার রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে রীতিমত দেশদ্রোহিতার শামিল। যেমন “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”- “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা”- “জিন্নার পাকিস্তার, আজিমপুরের গোরস্থান” ইত্যাদি। তখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। তারপর আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং ১৯৭১ এসে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সীমাহীন সাহসের সাথে বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষনা তথা ইশতেহার পাঠ এ দুঃসাহসিক ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। 

থাক- ডাকসুর অনেক সফল আন্দোলন- সংগ্রামের ইতিহাস এখানে বিস্তারিত বলে মোটেই শেষ করা যাবে না। সংক্ষেপে এইটুকু বলা যায়, ডাকসুসহ দেশের অপরাপর কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে অধ্যয়ণরত ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে গঠিত হতো ছাত্রসংসদ। তাঁরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তরিক সহমর্মিতায় পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাহিত্য- সংস্কৃতি ও ক্রীড়াসহ রাজনীতি এবং সমাজনীতির পরিচর্যা করতেন। কিন্তু আবার দেশ ও জাতির দুর্যোগময় সময়ে শাসন শোষনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সকল ছাত্রসহ আপামর জনতার পাশে দাঁড়াতেন। এই ধারাবাহিকতা স্বাধীনতার পরেও যুগে যুগে বিরাজমান ছিলো। ১৯৮৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি  জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের গনবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ডাকসুসহ ছাত্রসমাজ প্রথমে প্রতিবাদে জ্বলে উঠে। সেদিন বড় বড় রাজনীতিক দলগুলোর কোন অবদানই ছিলো না। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনীতিক দল ও নেতারা এই ছাত্রসমাজের পেছনে এসে আন্দোলনে শরীক হয়। মোটকথা, ডাকসুসহ সেদিনের ছাত্র, তরুন এবং যুবসমাজ ছিলো দেশ-জাতি এবং গনমানুষের সার্বিক উন্নতিতে নিবেদিনপ্রাণ। কোন লোভ- লালসা তাদের দেশপ্রেমে বাঁধার সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ ছাত্ররাজনীতির সকরুণ অবস্থা দেখলে অবাক ও বিষ্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে চরম দুঃখ ভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। আজ ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নেই। হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত হয়ে একে অপরের প্রতি করছে চরম বিষোদগার। জাতির আদর্শবান ও গনমানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে এবং মুক্তিযুদ্ধের অনাবিল চেতনায় একটি মানবিক সমাজ ও রাষ্ট প্রতিষ্ঠায় নেতা-কর্মী সৃষ্টি হবার সকল পথ আজ প্রায় রুদ্ধ। তাদের মধ্যে আজ গড়ে উঠছে আন্তরিক সম্পর্কহীনতার সুদৃঢ় প্রাচীর। এ চরম অবহেলা, সম্পর্কহীনতা ও বিদ্বেষ যে সমাজ ও রাষ্ট্রে যতবেশি, ওই দেশের রাজনীতি এবং সমাজনীতি ততবেশি অধপতিত হতে বাধ্য। আমাদের আদর্শভিত্তিক ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। আমরা ১০ নম্বর মহাবিপদের মুখোমুখি। এ চরম অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্রসংসদ- ডাকসুর মাধ্যমে সৃষ্টি হোক জাতির ভবিষ্যত কান্ডারী। আশাকরি ডাকসুর পরে দেশের অপরাপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনীতি এখন প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এটি ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর কাছে। সুতরাং এ দুরাবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়। শুধু ভয় হয়, বর্ষার ঘনঘোর অন্ধকার কালোরাতে আকাশের বিজলী যেমন হঠাৎ করে ক্ষনিকের চোখ ঝলসানো আলো দেয়, ঠিক তেমনি এ ডাকসু নির্বাচন সেই বিজলীর মতো হারিয়ে যাবে নাতো? আমরা ও জাতি কিন্তু এ নির্বাচনের সফলতায় আশাবাদী। কারন ফি বছর মহান জাতীয় সংসদে যেভাবে রাজনীতির জ্ঞান ধ্যান প্রায় বিবর্জিত ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী প্রাক্তন আমলাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে জাতি আজ চরম আতংকিত। এটি সমগ্র দেশ ও গন মানুষের জন্যে পুরোপুরি অভিশাপ। রাজনীতি পরিচালিত হোক সত্যকারের রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

" বিজয় ও অভ্র " ----যাদের কল্যাণে আমরা বাংলায় কথা বলি

মা

প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের পথচলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ